বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৬ পূর্বাহ্ন
বশির আল মামুন, চট্টগ্রাম ব্যুরো:
চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সড়ক পথে ভারতের ত্রিপুরায় পৌচেছে কন্টেইনারবাহী ভারতীয় পন্য। আজ ২২ জুলাই (বুধবার) সকালে কন্টেনারগুলো ত্রিপুরায় প্রবেশ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে আসার দুই ঘণ্টার মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্টের প্রথম চালানের চারটি কন্টেনার ভারতের ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। দ্রæত কন্টেনার খালাস এবং তা পুনরায় ভারতে পাঠানোর ক্ষেত্রে বন্দর এবং কাস্টমসের ভূমিকা সম্ভাবনার ট্রান্সশিপমেন্ট বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, ভারতের সাথে ট্রান্সশিপমেন্ট পুরো গতি পেলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন সেক্টরও বিকশিত হবে। স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা ট্রান্সশিপমেন্টকে স্বাগত জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরসহ এখানকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন, ট্রান্সশিপমেন্টে গতি আনতে এখনই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আট লেনে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
চট্টগ্রাম বন্দরের পদস্থ কর্মকর্তারা জানান, ভারতের কলকাতা থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের প্রথম চালানের চারটি কন্টেনার নিয়ে আসা জাহাজ এমভি সেঁজুতি গতকাল মঙ্গলবার সকালে বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছার কথা থাকলেও জাহাজটি প্রায় ৭ ঘণ্টা আগে সোমবার রাত ১টায় বহির্নোঙরে পৌঁছে।
গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জাহাজটিকে বার্থিং দেয়ার জন্য পাইলট যোগ দেন। বৃষ্টিতে কিছুটা প্রতিক‚লতার মাঝে বেলা দেড়টার কিছু পরে প্রায় ৯৬ মিটার লম্বা জাহাজটিকে নিউমুরিং টার্মিনালে কোস্টাল জাহাজ ভিড়ানোর জন্য নির্ধারিত এক নম্বর জেটিতে বার্থিং দেয়া হয়। এই জেটিতে বড় জাহাজ ভিড়ানো হয় না। এটি পানগাঁও-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী জাহাজের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে গত বেশ কয়েকদিন ধরে জেটিটি খালি ছিল। গতকাল এমভি সেঁজুতি বহির্নোঙরে পৌঁছার সাথে সাথে এটিকে বার্থিং দেয়া সম্ভব হয়েছে। অন্যথায় ফাস্ট কাম ফাস্ট সার্ভ নিয়মের মধ্যে জেটি খালি না থাকলে এমভি সেঁজুতিকে অপেক্ষা করতে হতো।
জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট ম্যাঙ্গো লাইন লিমিটেডের ব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান বলেন, এমভি সেঁজুতি ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দরে পৌঁছে। পরদিন ওই বন্দরের জেটিতে বার্থিং নেয়। কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বন্দর থেকে ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্যবোঝাই চারটি কন্টেনার নিয়ে জাহাজ কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পৌঁছে গত ১৮ জুলাই। সেখানে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কন্টেনার তোলার পর ১৯ রাতে যাত্রা করে। দুদিনের মধ্যেই জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে যায়। জাহাজটিতে ট্রান্সশিপমেন্টের চার টিইইউএস কন্টেনার পণ্য ছাড়াও বাংলাদেশি আমদানিকারকদের ১৫৬ টিইইউএস কন্টেনার পণ্য রয়েছে। এর বাইরে ১৪০ টিইইউএস খালি কন্টেনার রয়েছে। মোট ৩০০ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে ছোট আকৃতির কন্টেনার জাহাজটি বন্দরে বার্থিং নেয়ার পরই পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জাহাজটিতে জেটিতে ভিড়ার পর শুরুতে ১৪০ টিইইউএস খালি কন্টেনার নামানো হয়। এরপর বাংলাদেশি আমদানিকারকদের পণ্যবাহী বেশ কিছু কন্টেনার নামানোর পর রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ ট্রান্সশিপমেন্টের চারটি কন্টেনার ইয়ার্ডে নামানো হয়। এর মধ্যে দুটিতে ভারতের টাটা স্টিলের তৈরি ‘টিএমটি বার’ এবং অপর দুটিতে রয়েছে ডাল। আগরতলা থেকে খালাসের পর রডের চালানটি পশ্চিম ত্রিপুরার জিরানিয়ায় নেওয়া হয়েছে। ডালের চালানটি ভারতের এস এম করপোরেশনের। আগরতলায় খালাস করার পর ভারতীয় ট্রাকে করে এই ডাল আসামের করিমগঞ্জে জেইন ট্রেডার্সের গুদামে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ম্যানেজার কুদরত-ই খুদা মিল্লাত বলেন, জাহাজ থেকে ভারতীয় পণ্যবাহী চারটি কন্টেনার নামিয়ে সরাসরি গাড়িতে তোলা হয়েছে। কন্টেনারগুলোর ব্যাপারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। এগুলো স্ক্যানিং করার পরপরই আখাউড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। পণ্যগুলো পরিবহনকালে কাস্টমসের স্কট এবং ইলেকট্রিক লক থাকবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুই দেশের সরকার অনেক ভেবেচিন্তে যে চুক্তিটি করেছে আমরা তা বাস্তবায়ন করছি। এতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি মজবুত একটি ভিত পাবে। তিনি বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে আমরা খুবই পজিটিভ।
জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্যও দেশীয় আমদানিকারকদের মতো জাহাজ থেকে নামানোর পর চার দিন বিনা ভাড়ায় রাখা যাবে। এরপর থেকে স্বাভাবিক নিয়মে বন্দরের মাশুল দিতে হবে। ট্রান্সশিপমেন্টে আসা পণ্য সর্বোচ্চ সাত দিন বাংলাদেশে থাকতে পারবে। এর মধ্যে এসব পণ্য পুনরায় বের করে নিতে হবে। তবে বিশেষ প্রতিক‚ল পরিস্থিতি তৈরি হলে যথাযথ কারণ দেখিয়ে কাস্টমস থেকে বিশেষ অনুমোদন নিতে হবে।
ভারতের সাথে ট্রান্সশিপমেন্টে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সাত ধরনের ফি পাবে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা জানান, এর মধ্যে প্রতি চালানের প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি ১০০ টাকা, এসকর্ট ফি ৫০ টাকা, কন্টেনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি ১০০ টাকা।
প্রথম চালানের চারটি কন্টেনারে ১০০ টন পণ্য রয়েছে। প্রথম চালানের প্রতিটি কন্টেনারের জন্য সরকারি ফি ও বন্দর মাশুল বাবদ প্রায় ১০০ ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এর বাইরে বন্দর থেকে কন্টেনারগুলো আখাউড়া পর্যন্ত নিয়ে যেতে প্রতি কন্টেনারের জন্য বাংলাদেশের কন্টেনার মোভার প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা ভাড়া পাবে। ডলার হিসেবে যা প্রায় ৪৫০ ডলার থেকে বেশি। এর বাইরে জাহাজ ভাড়াও রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি কন্টেনারে ৭০০ ডলারের বেশি অর্থ বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পাবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহন নিয়ে ২০১৫ সালে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত এ প্রকল্পে ৮০ শতাংশ খরচ বহন করবে, বাকি ২০ শতাংশ খরচ দেবে বাংলাদেশ সরকার। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভারত সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়াস চালানো হয়েছিল। তারই ফলস্বরূপ এ দিনের যাত্রা।এরই মধ্যে পর্যটন এবং দু’দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযাগ স্থাপনের বিষয়ে উৎসাহ ইন্দো-বাংলার মধ্যে ক্রুজ পরিষেবাও শুরু হয়েছে।
এছাড়া ত্রিপুরার সাব্রæমে ফেনী নদীর ওপর একটি সেতু তৈরি হচ্ছে। চলতি বছরেই এটি চালু হয়ে যাওয়ার কথা। ওই সেতুটি হয়ে গেলে ত্রিপুরা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব আরও কমে যাবে বলে জানা গিয়েছে। তবে সাব্রæম পর্যন্ত রেলপথ এরই মধ্যে চালু হয়েছে।
ভয়েস/আআ